মানসিক রোগ চিকিৎসায় সামাজিক বাধা সমূহ

স্বাস্থ্যসেবা

 

মানসিক রোগ চিকিৎসায় সামাজিক বাধা সমূহ।

 

আসমা (ছদ্দনাম) তার সদ্য বিবাহিতা ছোট বোনকে নিয়ে এমনভাবে ভীতচকিত হয়ে চেম্বারে ঢুকলো যেনো তারা কোথাও কোনো কঠিন অপরাধ করে পালিয়ে এসেছে! কেউ দেখে ফেললে এখনি তাদর ধরে নিয়ে যাবে এবং শাস্তি হয়ে যাবে। কারণ জানতে চাইলে সে বললো – বোনের নুতন বিয়ে হয়েছে, আর তাকে নিয়ে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বারে আসা; পাছে শশুর বাড়ির কেউ কিংবা পরিচিত কেউ দেখে ফেলে, কে কি মনে করে! জানাজানি হলে বিয়েটাই না ভেঙ্গে যায়। তাই তারা সবার অগোচরে মুখ ঢেকে অনেক কায়দা করে এসেছে।

আসলে আমাদের সমাজে এটা খুবই পরিচিত একটা চিত্র। আমাদেরকে প্রতিদিনকার চেম্বার প্র্যাক্টিসে মাঝেমধ্যেই এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। যে কোনো শারীরিক অসুস্থতার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেও মানসিক অসুস্থতার জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হলেই আমাদের মধ্যে এক ধরনের লুকোচুরি ভাব চলে আসে। বিশেষ করে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়াটা তো একটা বিরাট লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আর এর কারণ হচ্ছে সামাজিক কুসংস্কার, লোকলজ্জা ও মানসিক রোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানসিক রোগ সম্পর্কে নিম্নে উল্লেখিত কিছু ভ্রান্ত ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে –

  • মানসিক রোগ আসলে কোনো রোগ না,
  • অতি প্রাকৃত কোনো শক্তির প্রভাবই মানসিক রোগের কারণ,
  • এর চিকিৎসা তাবিজ কিংবা পানি পরা,
  • চিকিৎসায় এ রোগ ভালো হয় না,
  • মানসিক রোগ মানে সামাজিক লজ্জা,
  • মানসিক রোগ মানেই বংশগত,
  • মানসিক রোগের ডাক্তার সব রোগীকে মানসিক রোগী বানিয়ে দেন,
  • মানসিক রোগের চিকিৎসকরা রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে রাখেন,
  • মানসিক রোগের ওষুধের অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে,
  • মানসিক রোগ ভালো হয়ে গেলে আর ওষুধ খাওয়ার দরকার নাই,
  • মানসিক ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমেই এই রোগ নিয়ন্ত্রন করা যায় এবং এর জন্য চিকিৎসার কোনো প্রয়োজন নেই,
  • শুধু কাউনসেলিং এর মাধ্যমেই মানসিক রোগ ভালো হয়,
  • মানসিক রোগের চিকিৎসকরাও একসময় মানসিক রোগী হয়ে যান,
  • বিয়ে দিলে মানসিক রোগ ভালো হয়,
  • মানসিক রোগ মানেই অস্বাভাবিক বা উল্টাপাল্টা আচরণ করা ইত্যাদি।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে-

  • অন্যান্য শারীরিক রোগের মতোই মানসিক রোগেরও বিভিন্ন কারণ রয়েছে, কাজেই মানসিক রোগ কোনো লজ্জার বিষয় নয়,
  • বংশগত প্রভাব মানসিক রোগের একটি কারণ মাত্র,
  • মানুষের শরীরের কিছু রাসায়নিক পদার্থের ঘাটতিও মানসিক রোগ সৃষ্টিতে দায়ী,
  • যেকোনো মানুষ তার জীবদ্দশায় যেকোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে,
  • প্রতিটি মানসিক রোগই কিছু নির্দিষ্ট উপসর্গের মাধ্যমে প্রকাশ পায় যার প্রতিটিরই বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা রয়েছে,
  • অধিকাংশ মানসিক রোগীই চিকিৎসার ফলে পূর্ণ সুস্থতা লাভ করে,
  • চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করলে সারা জীবন ওষুধও খেতে হয় না সবার,
  • মানসিক রোগের একাংশের জন্য প্রয়োজন হয় দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা,
  • অন্যান্য সব ওষুধের যেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে তেমনি মানসিক রোগের ওষুধেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে যা অন্য ওষুধের চেয়ে বেশি হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই,
  • একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জেনে বুঝেই রোগের ধরন এবং তীব্রতা অনুযায়ী ওষুধ দেন যাতে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না,
  • সব ওষুধ ঘুম আনে না বরং তা দৈনন্দিন কাজে উৎসাহ ও আগ্রহ বাড়ায়,
  • আসলে মানসিক রোগের অধিকাংশই আবেগজনিত কিংবা উদ্বেগজনিত যার প্রকাশ অনেকাংশেই শারীরিক এবং মোট মানসিক রোগীর স্বল্প ভাগের মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায় যাকে সাধারণত গুরুতর মানসিক রোগ বা সাইকোসিস বলে,
  • সাইকোসিসে কাউনসেলিং কিংবা সাইকোথেরাপির তেমন কোনো ভূমিকা নেই।

সর্বোপরি চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হওয়া একজন মানসিক রোগী অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো মর্যাদার সাথে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু এ স্বাভবিক জীবন পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় মানসিক রোগ ও তার চিকিৎসার প্রতি সাধারণ মানুষের ভ্রান্ত বিশ্বাস, ভুল ধারনা, কুসংস্কার আর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। যার ফলে রোগীদের তাবিজ. পানি পড়া, তেল পড়া জাতীয় অপচিকিৎসার দিকে ঠেলে দেয়া হয়।  শিক্ষা, চাকুরী, পারিবারিক কিংবা সামাজিকভাবে তাদের ভি্ন্ন চোখে দেখা হয়।

মানসিক রোগ বলে তাদের পিছনে সময় ও অর্থ ব্যয় করার প্রতি এক ধরনের অনীহা প্রদর্শন করা হয়। আর যদিও বা কেউ মানসিক রোগকে গুরুত্ব দিতে চান, তারা নানা সামাজিক কারণে কিংবা লোকলজ্জার ভয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে সাহস দেখান না। ফলে এসব রোগীরা মানসিক সুস্থতার পরিবর্তে অসুস্থতার অন্ধকারেই ঘুরপাক খেতে থাকে দিনের পর দিন। জীবন এগিয়ে যায় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। কাজেই অপচিকিৎসার কবল থেকে মুক্ত করে একজন মানসিক রোগীকে অন্যান্য রোগীদের মতো বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসার আওতায় নিয়ে এসে তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার বিকল্প আর কিছুই নেই। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি অন্যান্য সকল চিকিৎসকদেরকেও মানসিক রোগীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করতে হবে।

 

ডা. সুস্মিতা রায়
সহযোগী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ,
জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, সিলেট।

Related posts

Leave a Comment